গোলাম কবিরের কবিতাগুচ্ছ
বড়ো বেশি দ্বিধায় পড়ে যাই
তোমার হাসিভরা মুখ দেখে আমার
অভিমানের বরফ যতোটুকু গলে
তারচেয়ে ঢের বেশি খুন হয়ে যাই
তোমার চোখের ভাষায়।
তোমার মুখের ভাষায় যতো কথা বলো
তারচেয়ে ঢের বেশি বলো চোখের তারায়!
ভালোবাসি শব্দটা যতোবার উচ্চারণে বলো
তারচেয়ে ঢের বেশি বলো
তোমার লাজুক চোখের ভাষায়!
মুখের ভাষায় যতোটুকু ঘৃণা ও প্রত্যাখান
প্রকাশ করো তারচেয়ে ঢের বেশি
প্রকাশ হয়ে যায় চোখের ভাষায়।
তাই যখন রেগেমেগে বলো ভালোবাসো না
তখন বুঝি তোমার চোখ দেখে
এর একটা কথাও সত্যি কথা না !
একটা সমুদ্র যতোটুকু জল ধারণ করে
তোমার অভিমানী চোখ তারচেয়ে
ঢের বেশি জল ধরে রাখে অক্ষিকোটরে।
তাই বড়ো বেশি দ্বিধায় পড়ে যাই
তোমার চোখ নাকি মুখের ভাষায়
উচ্চারিত শব্দের ওপর আস্থা রাখবো।
দুঃখ বিলাসী
সুখ যে কোনো মানুষের জীবনে
ক্ষণস্থায়ী মুহূর্তের জন্য তৃপ্তি এনে দেয়,
তাই সুখের উল্লাসে আত্মহারা হতে চাই না!
দুঃখ বিলাসী আমি তাই দুঃখকেই ভালোবাসি
কারণ সে আমার চিরসখা।
ও আমার সিথানের কাছে থাকবে
বেহুলা লখিন্দরের মতো।
সুখের মতো পালিয়ে যাবে না দুঃখ দিয়ে!
তাই সুখের কথা ভুলে গিয়ে
দুঃখ নিয়েই বেঁচে থাকি ।
ধূসর সভ্যতার কান্না
আমাদের নদীগুলো ভীষণ কান্না করছে,
ওদের বুকে জলের জন্য হাহাকারের শব্দে
ঘুম উধাও হয়ে গেছে পাহাড়ের বুক চিরে
বেরিয়ে আসা জলপ্রপাতদের!
আকাশ জুড়ে কালো রঙের মেঘ জমে জমে
বৃষ্টি হতে চাইছে কিন্তু হচ্ছে না,
কেমন একটা থমথমে অবস্থা বিরাজমান
মেঘেদের পরিবারে, মানুষের হৃদয়ে
এখন আর ফোটে না গোলাপ!
কিন্তু তাই বলে কী কবিতা লিখবে না কবিগণ?
ওরা তবুও কবিতা লিখে হৃদয় চিরে রক্তের অক্ষরে,
শহরের বুকে জলপাই রঙের পোশাক পরে
সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে যাচ্ছে কিছু বরাহ!
নিরীহ শিশুরা মায়ের কোলে শুয়ে গল্প শোনার
বায়না ধরতে ভুলে গিয়ে মোবাইলে টিকটক
ভিডিও দেখায় ব্যস্ত সময় পার করছে!
ফুলগুলো সব রঙ ও গন্ধ হারিয়ে একদম
শুকিয়ে ঝরে পড়ছে অকালেই!
আমরা সবাই মিলে খাল কেটে কুমির আনার
মতো করে আমাদের সভ্যতাকে ধ্বংস করছি
নিজেদের সৃষ্ট বিজ্ঞানের চরম উদ্ভাবনী শক্তির
অপপ্রয়োগে, জীবন প্রতিদিনই হাতুড়ির নিচে
পিষ্ট হচ্ছে অথচ এখনো আমরা সবাই
নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে আছি
আসহাবে কাহাফের সেই মানুষদের মতো!
আমাদের রঙিন স্বপ্নগুলো স্বপ্নচোর ভোরের
হাওয়ায় উড়ে যাচ্ছে কুয়াশা ঘেরা গহীন আঁধারে!
এদিকে তখন মহার্ঘভাতা, উৎসব বোনাস ও
বকেয়া ঘুষের টাকার জন্য হরতাল ডেকেছে
একদল তথাকথিত উচ্চপদস্থ শয়তানের দোসরগণ!
মানুষের জীবন তবুও যাচ্ছে কেটে
সুতো কেটে উড়ে যাওয়া ঘুড়ির মতো
কোন অজানায় কেই-বা তা জানে!
জানতে পারলে আমাকেও একটু জানিও,
দোহাই তোমাদের আগামী প্রজন্মের
প্রথম সকালে দেখা সূর্যের স্নিগ্ধ হাসির!
সভ্যতার চরম উৎকর্ষের দিনে
এখানে অন্ধকার জেঁকে বসে আছে
প্রাগৈতিহাসিক অন্ধকার যুগের মতো !
এখানে ধর্ষকেরা সগৌরবে চিৎকার
করতে করতে ফিরে আসে বারবারই,
লোকালয়ে যেমন করে বুড়ো বুনোবাঘ আসে
শিকারের খোঁজে ঠিক তেমনি করে!
এখানে ইতিহাস মুছে দিয়ে নতুন করে
ইতিহাস লেখা হয় নিজের ইচ্ছেমতো নিজ হাতে,
পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয় এমন কাণ্ড দেখে!
এখানে পৃথিবীরই কোথাও একদল মানুষরূপী
দানবদের হাত থেকে মাত্র কয়েক লক্ষ
মানুষের জীবন বাঁচাতে এগিয়ে আসে না
পুরো বিশ্বের মানুষেরা, ওরা যেনো
ঘুমিয়ে আছে ব্যাঙের শীতনিদ্রার মতো
নাহয় আবাবিল পাখিদের অপেক্ষায় থাকে
ওদের বাঁচাতে আসবে মনে করে
শুধু অক্ষম দুহাত তুলে ওপরে !
এখানে সভ্যতার নামে চরম অসভ্যতা,
নৈরাজ্য ও অমানবিকতার ছোবলে
বিপন্ন হয় প্রকৃত অর্থে সভ্যতাই !
লজ্জিত হয় প্রকৃত মানুষ এবং মানবতা!
এখানে তবুও ভোর হয়, পাহাড়ি ঝর্ণাধারার জল
উৎস থেকে নেমে এসে
সমতলে বয়ে যায় নদী হয়ে!
এখানে তবুও ফুল ফোটে সুবাস ছড়িয়ে
রঙে রঙে রঙিন হয়ে ওঠে মধুর বসন্তদিন!
এখানে তবুও শিশুরা হাসে, খেলে, গান গায়,
ক্ষুধায় কষ্ট পেলে কান্না করে,
কখনো আল্লাহর কাছে নালিশ করে,
নালিশ করে ওদের নিরাপত্তাসহ
নূন্যতম জীবন যাপনের অধিকার হারিয়ে!
অথচ জেনেছি এখন নাকি
সভ্যতার চরম উৎকর্ষের দিন চলছে!
তোমার হাসি
হাসলে তোমাকে কখনো ভীষণ সুন্দর
পরাবাস্তব কবিতার মতো লাগে,
কখনো চাঁদের বাঁধ ভাঙা হাসিকেও হার মানায়,
কখনো মনেহয় শরতের শিউলি ফোটা
ভোরের স্নিগ্ধ আলোয় আলোকিত
উজ্জ্বল ঝলমলে রোদেলা সকাল!
অথচ বললে তুমি হেসেই উড়িয়ে দাও
যেভাবে কোনো খুনি ব্যাটার
তার ব্যাট দিয়ে দুর্দান্ত গতির
পেস বোলারের বিপক্ষে ছক্কা হাঁকায়!
আরও পড়ুন- রহিত ঘোষালের কবিতা